সিলেট দিগন্ত ডেস্কঃ দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াহিদা খানম ও তার বাবার ওপর হামলার ঘটনায় ইউএনওর কার্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির সাবেক কর্মচারী রবিউল ইসলামের ডিএনএ শনাক্ত হয়েছে। হামলার সময় রবিউলের পরনের প্যান্টে রক্তের দাগ লাগে। আদালতের মাধ্যমে ইউএনওর বাবার রক্তের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। রবিউলের প্যান্টে লেগে থাকা রক্তের নমুনা পরীক্ষা করে ডিএনএ-বৃত্তান্ত (প্রোফাইল) পাওয়া গেছে। এতে দেখা গেছে, রবিউলের প্যান্টে থাকা রক্তের সঙ্গে ওয়াহিদার বাবার ডিএনএ প্রোফাইল পুরোপুরি মিলে গেছে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির ঢাকার ল্যাবে ডিএনএ নমুনা পরীক্ষা করে তার প্রতিবেদন এরই মধ্যে আদালতে পাঠানো হয়েছে। প্রতিবেদনের অনুলিপি শিগগির মামলার তদন্ত সংস্থা দিনাজপুর জেলা ডিবি পুলিশের কাছেও যাবে। একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র থেকে গতকাল এ তথ্য পাওয়া গেছে।
এ ছাড়া ইউএনওর বাসার বিভিন্ন জিনিসপত্র পরীক্ষা করে সেখানে মোট চারজন পৃথক ব্যক্তির ডিএনএ বৃত্তান্তের তথ্য মিলেছে। তাদের মধ্যে তিনজনের ডিএনএ প্রোফাইল হলো বাসার বাসিন্দাদের। তারা হলেন ওয়াহিদা খানম, তার ছোট সন্তান ও বাবা। আর বাসার বাইরের যে একজনের ডিএনএ প্রোফাইল পাওয়া গেছে, সেটি হলো রবিউলের। ডিএনএ-বৃত্তান্ত পাওয়ার পর ইউএনওর ওপর হামলার ঘটনায় জড়িত থাকার ব্যাপারে রবিউল একক ব্যক্তি হিসেবে শনাক্ত হলো। এ বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ থাকল না বলে মনে করছেন সংশ্নিষ্টরা। ইতোমধ্যে পুলিশ বলে আসছিল, রবিউল একাই ওই হামলায় জড়িত। তারপরও নানা মহল হামলাকারীর ব্যাপারে বিভিন্ন সংশয় ও প্রশ্ন তোলে।
তদন্ত সংশ্নিষ্ট এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সমকালকে জানান, ঘটনার সময় রবিউল বাসায় ঢুকে বিছানায় শোয়া থাকা অবস্থায় ইউএনওকে হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে। এরপর ইউএনওর বাবা এগিয়ে এলে তার সঙ্গে ধস্তাধস্তি হয়। তাকেও আঘাত করে রবিউল। পরে ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে ডিএনএ স্যাম্পল সংগ্রহ করা হয়। রবিউলের রক্তমাখা প্যান্টও জব্দ করা হয়। আদালতের আদেশে এগুলো সিআইডির ল্যাবে পাঠান তদন্ত কর্মকর্তা।
ডিএনএ (ডি অক্সিরাইবো নিউক্লিক এসিড) মূলত জীবদেহের গঠন ও ক্রিয়াকলাপ নির্দেশ করে। এটি জিনের একটি উপাদান। একজন মানুষের সব ধরনের বৈশিষ্ট্য বহন করে ডিএনএ। চুল, কফ, হাতের ছাপ, থুতু, রক্তসহ শরীরের যে কোনো উপাদান থেকে ডিএনএ পরীক্ষা করা যায়। পরীক্ষার মাধ্যমে ডিএনএ-বৃত্তান্ত পাওয়ার পর যে কোনো ব্যক্তিকে শনাক্ত করা সম্ভব। ডিএনএ শনাক্তের মধ্য দিয়ে যে কোনো ঘটনায় অপরাধী শনাক্ত বিশ্বব্যাপী একটি স্বীকৃত পদ্ধতি। আমাদের দেশেও অনেক চাঞ্চল্যকর ঘটনায় আসামি শনাক্ত হয়েছে ডিএনএর মাধ্যমে। সন্দেহভাজন ব্যক্তি যেখানে যেখানে স্পর্শ করবে, সেখান থেকে আলামত নিয়েও ডিএনএ শনাক্ত করা যায়। তদন্ত-সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, দিনাজপুরের ঘটনায় ইউএনও ছাড়াও তার বাবা ও শিশুর ব্যবহূত জিনিসপত্র ডিএনএ পরীক্ষার জন্য সিআইডির ল্যাবে পাঠানো হয়েছিল।
গত ২ সেপ্টেম্বর রাতে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গণের সরকারি বাসভবনের ভেন্টিলেটর দিয়ে ঢুকে ইউএনও ওয়াহিদা ও তার বাবা ওমর আলীর ওপর হামলা চালানো হয়। মাথায় হাতুড়ির আঘাতে গুরুতর আহত হন ওয়াহিদা খানম। তার বাবাও গুরুতর আহত হন। দু’জনই এখন আশঙ্কামুক্ত।
ইউএনওর ওপর হামলার ঘটনায় প্রথমে গত ৪ সেপ্টেম্বর র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হন স্থানীয় যুবলীগ নেতা আসাদুল হক ও তার দুই সহযোগী নবীরুল ইসলাম ও সান্টু কুমার বিশ্বাস। তখন র্যাব দাবি করেছিল, তারা এ ঘটনার ছায়া তদন্ত করেছে। গ্রেপ্তার আসাদুল নিজের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। এ ঘটনার মূল আসামি তিনি। পূর্বপরিকল্পিতভাবে চুরির উদ্দেশ্যে তারা ইউএনওর বাসায় ঢোকেন।’ তবে ১৩ সেপ্টেম্বর রবিউল ইসলাম পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারের পর এ ঘটনা নাটকীয় মোড় নেয়। পুলিশ দাবি করে, আসাদুল ওই ঘটনায় জড়িত ছিলেন না। জড়িত রবিউল।
সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, চুরির দায়ে ইউএনওর কার্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী রবিউল সাসপেন্ড হন। ইউএনওর ব্যাগ থেকে ১৬ হাজার টাকা চুরি হয়। পরে তাকে ফেরত দিতে হয় ৫০ হাজার টাকা। এ ঘটনায় যাতে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় বা শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা নেওয়া না হয়, সে ব্যাপারে অনুরোধ করেছিল ইউএনওকে। এরপরও তাকে সাময়িক বরখাস্ত এবং বিভাগীয় মামলা করা হয়। সাসপেন্ড হওয়ায় ইউএনওর ওপর ক্ষোভ ছিল তার। আরেকদিকে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ায় হতাশাও কাজ করছিল। এই ক্ষোভ থেকে হামলার সিদ্ধান্ত নেয় রবিউল।
তদন্ত-সংশ্নিষ্ট এক দায়িত্বশীল কর্কর্তা সমকালকে বলেন, রবিউল স্বীকার করেছে সে একাই সেই রাতে ইউএনওর বাসায় যায়। দিনাজপুর এসে সে ওই অপারেশনে অংশ নেয়। বাসার মালি থাকায় ইউএনওর বাসার কোথায় কী রয়েছে, তা খুব ভালো করে জানত রবিউল। তদন্ত-সংশ্নিষ্টরা বলছেন, এই মামলার মূল তদন্ত প্রায় শেষ। এরই মধ্যে নিজের সব অপরাধ স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে রবিউল। রবিউলের অপরাধ প্রমাণে পাঁচ সাক্ষীও রয়েছেন। এ ছাড়া মোবাইল ফোনের কল লিস্টের সূত্র ধরেই রবিউলের অনেক তথ্য সামনে এসেছে। এখন মিলল ডিএনএ-বৃত্তান্ত। ওয়াহিদার ওপর হামলার ঘটনায় মেডিকেল প্রতিবেদন পাওয়া গেলে শিগগির চার্জশিট দেবে পুলিশ।
সূত্র জানায়, চার্জশিট দেওয়ার পরই ওয়াহিদার ওপর হামলার ঘটনায় সন্দেহভাজন হিসেবে যারা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, তারা তাদের ‘দায়’ থেকে মুক্তি পাবেন। ঘোড়াঘাটের ওই ঘটনায় আসাদুল, জাহাঙ্গীরসহ তিন যুবলীগ নেতাকে বহিস্কার করা হয়েছিল। এ ছাড়া হামলার ঘটনার সূত্র ধরে দিনাজপুর আওয়ামী লীগের গ্রুপ-উপ গ্রুপের দ্বন্দ্বের নানা তথ্য সামনে আসে। বিভিন্ন গ্রুপিংয়ে দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়েছে। অভিযোগ আছে, স্থানীয় প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায় থেকে দলীয় গ্রুপিং জিইয়ে রেখে বিভিন্ন ধরনের অনৈতিক সুবিধাও নেওয়া হয়।